Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব

আলী শাহান শাহ্ বাবা আদম কাশ্মিরীঃ জন্ম পনেরো শতক, মৃত্যু ১৬১৩ সাল। ধর্মপ্রচারক ও পীর ছিলেন। বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হুসায়েন শাহ কর্তৃক আতিয়ার জায়গিরদার নিযুক্ত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। ১৫৯৮ সালে জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে আলী শাহান শাহ্ বাবা আদম কাশ্মিরীকে আতিয়া পরগণা দান করা হয়। আতিয়া শব্দের অর্থও দান। তিনি দীর্ঘ ১৫০ বছর পরমায়ু লাভ করেছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। তিনি নিজের ব্যয়ের জন্য রাজকোষ থেকে সামান্য কিছু অর্থ গ্রহণ করে অবশিষ্ট অর্থ জনকল্যাণে যেমন : মক্তব, মাদ্রাসা, রাস্তাঘাট তৈরিতে ব্যয় করতেন। তাঁর আমলে উৎকৃষ্ট শ্রেণীর কাগজ তৈরি হতো আতিয়াতে। শাহন শাহ্ বাবা কাশ্মিরী ১৬১৩ সালে মৃত্যুবরণ করলে আতিয়াতেই তাকে সমাহিত করা হয়। আজও আতিয়াতে তাঁর মাজার আছে। মৃত্যুর পূর্বে বাবা কাশ্মিরী প্রিয়ভক্ত সাঈদ খাঁকে আতিয়া পরগণার শাসনভার অর্পণ করেন এবং তাঁর পরামর্শক্রমে সুবেদার ইসলাম খাঁর সুপারিশে দিল্লির মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীর ১৬০৮ সালে সাঈদ খাঁকে আতিয়া পরগণা ও বাবা কাশ্মিরীর ভাগিনা শাহজামানকে কাগমারী পরগণার শাসনর্কতা নিয়োগ করেন। এই সাঈদ খাঁ করটিয়া জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা।

 

শাহজামানঃ জন্ম আনুমানিক ষোলোশতক। মৃত্যু ১৬৬৩ সালে। তিনি ঐতিহাসিক কাগমারী পরগণার সুশাসক ও আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞা বিশিষ্ট আলেম হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় টাঙ্গাইল পিতল, কাঁসা, তাঁতবস্ত্র, দই, মিষ্টি ইত্যাদিতে সুখ্যাতি অর্জন করে। তিনি কাগমারীতে একটি মক্তব স্থাপন করেন। পরবর্তীতে মওলানা ভাসানী এখানে এম.এম আলী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। শাহজামান ছিলেন আতিয়া পরগণার শাসনকর্তা বাবা আদম শাহ্ কাশ্মিরীর স্নেহে পালিত ভাগ্নে। বাবা কাশ্মিরীর অনুরোধেই বাংলার মোগল সুবেদার ইসলাম খাঁ ১৬০৮ সালে কাগমারী পরগণার শাসনকর্তা হিসেবে শাহজামানকে নিযুক্ত করেন। ১৬০৮ সালে কাগমারী পরগণায় শাসনর্কতা নিয়োগের সময় শাহজামানের বয়স ছিলো ৩০ বছর। তিনি একটানা ৫০ বছর নিযুক্ত ছিলেন কাগমারী পরগণার শাসকরূপে। তিনি সুবেদার ইসলাম খাঁর আদেশে প্রথম কাগমারীতে ভূমি জরিপ করেছিলেন। প্রজাদের চিকিৎসার জন্য তিনি পরগণার কয়েকটি জায়গায় চিকিৎসক নিয়োগ করে দাওয়াখানা স্থাপন করেন।

 

মৌলভী মোহাম্মদ নঈমউদ্দিনঃ মৌলভী মোহাম্মদ নঈমউদ্দীন ১৮৩২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইল সদর উপজেলার সুরুজ গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মৌলভী মোহাম্মদ রুকন উদ্দিন। নইমউদ্দিন উপমহাদেশের মুশির্দাবাদ, এলাহাবাদ, জৈনপুর, বিহার, আগ্রা, দিল্লি প্রভৃতি স্থানের দেশবরেণ্য বিখ্যাত আলেম ও ইসলামি চিন্তাবিদদের নিকট থেকে ইলমে শরীয়ত (জাহেরী) ও ইলমে মারেফাত (বাতেনী বিদ্যা) আয়ত্ত করেন। তিনিই সর্বপ্রথম কোরান ও বোখারী শরীফ অনুবাদ করে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। আপাত দৃষ্টিতে দেখা যায় গিরিশ চন্দ্র সেন পবিত্র কোরানের প্রথম সম্পূর্ণ অনুবাদ করেন; এই অনুবাদ কর্মের প্রথম পথিকৃত মৌলভী নঈমউদ্দিনই। মৌলভী নঈমউদ্দিন কর্তৃক বাংলায় অনূদিত কোরান শরীফের প্রথম খন্ড ১৮৯১ সালে করটিয়ার জমিদার হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নীর আনুগত্যানুসারে মৌলভী গোলাম সারোয়ার সাহেবের সহযোগিতায় করটিয়া মাহমুদিয়া প্রেসে মুদ্রিত ও মীর আতাহার আলী কর্তৃক প্রকাশিত। পৃষ্ঠা ৪০৬ (৬+৪০০) হাদিয়া ২ টাকা ৪ আনা। টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা ‘আখবারে এছলামিয়া’করটিয়া জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনিই সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন ১৮৮৩ সালে। পত্রিকাটি সুদীর্ঘ দশ বছর প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ছোটো বড় মিলিয়ে অর্ধশত গ্রন্থ রচনা করেন। তার উল্লেখযোগ্য বই হলো জোব্দাতুল মাসায়েল (১৮৯২), এনসাফ (১৮৯২), এজবাতে আখেরেজ্জোহর (১৮৮৭), ফতোয়ায়ে আলমগীরী (১৮৯২), কলেমাতুল কোফর (১৮৯৭) ইত্যাদি। ১৯০৮ সালে ২৩ নভেম্বর এই জ্ঞানতাপস মৃত্যুবরণ করেন।


ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (চাঁদ মিয়া): ১৮৭১ সালে ১৪ নভেম্বর সদর উপজেলার অন্তর্গত করটিয়ার বিখ্যাত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর পিতার নাম হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী। মাতার নাম খোদেজা খানম। তিনি ছিলেন করটিয়ার জমিদারদের মধ্যে সবচেয়ে প্রজাহিতৈষী। তিনি জমিদার তথা ময়মনসিংহ জেলা কংগ্রেস ও খেলাফত কমিটির সভাপতি, বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সহ-সভাপতি এবং নিখিল ভারত কংগ্রেসের নির্বাহী পরিষদ সদস্য হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশ বিরোধী আযাদী আন্দোলন করে কারাবরণ করেন ১৯২১ সালে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তাঁর অনমনীয় মনোভাব ও দৃঢ়তার জন্য ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত তাঁর তৈলচিত্রের নিচে লেখা রয়েছে- “One who dified the British.”

 

চাঁদ মিয়া পিতার প্রতিষ্ঠিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে উচ্চ ইংরেজি শিক্ষার বিদ্যালয়ে উন্নীত করে ‘হাফেজ মাহমুদ আলী ইনস্টিটিউশন’নামকরণ করেন ১৯০১ সালে। ইংরেজ মি. স্মিথকে নিযুক্ত করেন প্রধান শিক্ষক হিসেবে। ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর উদ্যোগে করটিয়ায় ১৯০৬ সালে সারা বাংলার মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ্। এই ধারাক্রমে ১৯১০ সালে করটিয়ায় ইতিহাস খ্যাত মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। চাঁদ মিয়া প্রতিষ্ঠিত পিতামহের নামে করটিয়ার স্থাপিত ‘সা’দত কলেজ’(১৯২৬ সালে) টাঙ্গাইল তথা বৃহত্তর ময়মনসিংহে শিক্ষা বিস্তারে গর্বোন্নত শিরে দাঁড়িয়ে আছে। এটি বাংলাদেশে মুসলমান প্রতিষ্ঠিত প্রথম বেসরকারি কলেজ। একই বছর অর্থাৎ ১৯২৬ সালে স্ত্রীর নামে রোকেয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। 

এছাড়াও তিনি বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পত্র-পত্রিকা, বই পুস্তক প্রকাশনায় অর্থ দান করেছেন। চাঁদ মিয়া ১৯২১ সালে আলীপুর (কলিকাতা) জেলে থাকাকালীন ব্যারিস্টার আবদুস রসুল প্রতিষ্ঠিত ও মুজিবুর রহমান সম্পাদিত ‘দি মুসলমান’পত্রিকার জন্য আর্থিক সাহায্যদান। জনহিতকর কাজের ব্রতে তাঁর বার্ষিক লক্ষ টাকা আয়ের জমিদার ওয়াকফ্ করেছেন। এই ওয়াকফ্ থেকে বৃত্তি পেয়ে ফজিলাতুননেছা জোহা ও এ জববার (চীফ ইঞ্জিনিয়ার) বিদেশে গমন করেন। ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে করটিয়ায় ন্যাশনাল স্কুল স্থাপন করে শত শত চরকা বসান। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অনেক ব্যারিস্টার, হাকিম, চাকুরিজীবী যোগ দিয়েছেন কিন্তু চাঁদ মিয়ার মতো চারলক্ষ টাকা আয়ের ভূম্যাধিকারী নিজেরও সম্পদের মায়া বিসর্জন দিয়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন কিনা তা আমাদের জানা নেই।

 

জমিদারদের স্বার্থ রক্ষায় বৃহত্তর ময়মনসিংহের জমিদাররা একটি সংগঠনের জন্য পাঁচশত টাকা চাঁদা চাঁদ মিয়ার কাছে চাইলে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কারণ এই সংগঠন প্রজাদের কল্যাণে প্রবর্তিত প্রজা স্বত্ব আইনের বিরোধিতা করতো। মজলুম নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খাঁন ভাসানী বলতেন এ দেশের জমিদাররা সবাই চাঁদ মিয়ার মতো হলে আমি জমিদারি উচ্ছেদ আইন সমর্থন করতাম না। উল্লেখ্য, দানের ক্ষেত্রে ওয়াজেদ আলী খান পন্নী অদ্বিতীয় ছিলেন। এজন্যই তাকে ‘দানবীর’, ‘দ্বিতীয় মহসিন’উপাধিতে ডাকা হতো। ১৯৩৬ সালে ২৫ এপ্রিল শনিবার তিনি ৬৭ বছর বয়সে করটিয়ায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। 


মন্মথনাথ রায় চৌধুরীঃ জন্ম ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮০ সালের সন্তোষ জমিদার পরিবারে। তাঁর পিতা দ্বারকানাথ রায় চৌধুরী ও মাতা বিন্দুবাসিনী রায় চৌধুরানী। তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএল। সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত হন ছাত্রাবস্থায়। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথের শিষ্য ছিলেন। মন্মথনাথ রায় চৌধুরী তৎকালীন বাংলা সরকারের মন্ত্রী ও বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সভাপতি ও একজন ভালো ক্রীড়াবিদ ছিলেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় হিসেবে পরপর ছয়বার তৎকালীন ইন্ডিয়ান ফুটবল এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। তিনি কলকাতার সন্তোষ ট্রফি খেলার উদ্যোক্তা। এছাড়া তিনি বেঙ্গলী পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। এছাড়াও তিনি সন্তোষ, টাঙ্গাইলে একাধিক স্কুল ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। টাঙ্গাইল শহরে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার প্রথম কলেজটি স্থাপন করেন ১৯০০ সালে। ‘প্রমথ-মন্মথ কলেজ’নামে এটি প্রায় দশ বছর চালু ছিলো। পরবর্তী সময়ে এটি ঢাকার জগান্নাথ কলেজের সাথে একীভূত হয়। বর্তমানে কলেজটি না থাকলেও এলাকাটি ‘কলেজপাড়া’নামে পরিচিত।

 

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীঃ ভারতীয় উপমহাদেশের বুভুক্ষু মানুষের মজলুম নেতা। যেখানে অন্যায়-অবিচার সেখানেই একটি প্রতিবাদী কণ্ঠ, একটি ভূকম্পিত হুঙ্কারের নাম মওলানা ভাসানী। ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর পূর্ববঙ্গের প্রবেশপথ খ্যাত সিরাজগঞ্জ জেলার সয়াধানগড়া গ্রামে এক বনেদি মুসলিম পরিবারে মওলানা ভাসানী জন্মগ্রহণ করেন। মওলানা ভাসানীর পিতার নাম হাজী শরাফত আলী খান। সিরাজগঞ্জ জন্মগ্রহণ করলেও টাঙ্গাইলে বিবাহ করে জীবনের অধিকাংশ সময় স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন বলে ভাসানী টাঙ্গাইলের অধিবাসী হিসেবে বেশি পরিচিত। জীবনের প্রথমার্ধে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী নেতা মওলানা মোহাম্মদ আলী, মওলানা শওকত আলী, মওলানা আবুল কালাম আজাদ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। ১৯২৬-এ আসামে প্রথম কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। ১৯২৯-এ আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠান। এখান থেকে নামের শেষে ভাসানী শব্দ যুক্ত। ১৯৩১-এ সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২-এ সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায় ও ১৯৩৩-এ গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠান। ১৯৩৭-এ কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান। একই বছর আসামে বাঙালি নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ‘লাইনপ্রথা’চালু হলে এই প্রথা-বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৪০-এ শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের সঙ্গে মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত ও পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ। তিনি ১৯৪৪ আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। এ সময় দল ও দলের বাইরে বাঙালি কৃষকদের অধিকার আদায়ে দুর্বার আন্দলন গড়ে তোলেন। 

ভাসানী ১৯৪৯ সালে পাকিস্তানে প্রথম বিরোধীদল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’গঠন করে এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তার সাহসী ভূমিকা উজ্জ্বল হয়ে আছে। ১৯৫২-র ৩০ জানুয়ারি ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরি হলে তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত এবং এর অন্যতম প্রধান সদস্য নিযুক্ত। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন (ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)-এ সহযোগিতার জন্য গ্রেফতার। ১৬ মাস কারানির্যাতন ভোগ। পূর্ববঙ্গ পরিষদের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে মোকাবেলা করার লক্ষ্যে ১৯৫৩-সালের ৩ ডিসেম্বর কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক ও তাঁর দল নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের আহবায়ক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে যুক্তফ্রন্ট গঠন। নির্বাচন (৮-১১ মার্চ ১৯৫৪)- যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয় অর্জন। 

যুক্তফ্রন্ট পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা এ.কে. ফজলুল হক কর্তৃক পূর্ববঙ্গে সরকার গঠন (৪ এপ্রিল ১৯৫৪)। ভাসানী পূর্ব বাংলার খাদ্যজনিত দুর্ভিক্ষ রোধকল্পে কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট থেকে ৫০ কোটি টাকা আদায়ের দাবিতে ১৯৫৬-র ৭ মে ঢাকায় অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। সরকার দাবি মেনে নিলে ২৪ মে ১৯৫৬ অনশন ভঙ্গ করেন। এই বছর ১২ সেপ্টেম্বর হোসন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলে মওলানা ভাসানী কর্তৃক সরকারের মার্কিন ঘেঁষা পররাষ্ট্র নীতির বিরোধিতা। নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ ও পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন প্রদানের জন্য তৎকর্তৃক সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ। মূলত এ থেকেই সোহরাওয়ার্দী-পন্থীদের সঙ্গে ভাসানীর মতবিভেদ তৈরি হয়।


পাকিস্তানের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্মেলন তিনিই ডাকেন ১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে। যা কাগমারী সম্মেলন নামে ইতিহাসখ্যাত। এই সম্মেলনে তিনি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীকে ‘আস্সালামু আলাইকুম’বলে বিদায় জানিয়েছিলোন। কাগমারী সম্মেলনের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব-এর সাথে তার বিচ্ছেদ সৃষ্টি হয়েছিল। ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করলে ১৮ মার্চ ১৯৫৭ আওয়ামী লীগ থেকে ভাসানী পদত্যাগ করেন। একই বছর ২৫ জুলাই ১৯৫৭ তাঁর নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহলো সিনেমা হলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হয়। তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৬-তে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উপস্থাপিত ৬-দফা কর্মসূচির বিরোধিতা করে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া পরিচালনা করেন ভাসানী। 

১৯৬৭ নভেম্বরে ন্যাপ দ্বি-খন্ডিত হলে চীনপন্থী ন্যাপের নেতৃত্ব গ্রহণ। ১৯৬৯-এর জানুয়ারি-মার্চের আইয়ুববিরোধী গণ-আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১-দফা কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন। আইয়ুব খানের পতনের পর ইয়াহিয়া খান নির্বাচনের ঘোষণা দিলে ভাসানী দাবি তোলেন ‘ভোটের আগে ভাত চাই’, দেশে ‘ইসলামিক সাংস্কৃতিক বিপ্লব’সংঘটন, ‘ইসলামিক সমাজতন্ত্র’কায়েম ইত্যাদি দাবি উপস্থাপন। নির্বাচনের কিছুদিন পূর্বে ১২ নভেম্বর ১৯৭০ পূর্ব পাকিস্তানের উপকূল অঞ্চলে এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হলে দুর্গত এলাকায় ত্রাণ কাজকে অগ্রাধিকার দিয়ে এবং পশ্চিমা সরকার ঘূর্ণিদুর্গতদের জন্য কোনো ব্যবস্থা না-নিলে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। ৪ ডিসেম্বর ১৯৭০ ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় সভাপতির ভাষণ দানকালে ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’দাবি উত্থাপন। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্ত্ততি পর্বে ভাসানী শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন (৩-২৫ মার্চ ১৯৭১)-এর প্রতি সমর্থন প্রদান করেন।


১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২-এর ২ জানুয়ারি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন। একই বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘হক কথা’প্রকাশ। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধির মধ্যে যে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ভাসানী তার বিরোধিতা করেন। তবে তিনি ১৯৭২-এর সংবিধান ও ব্যাংকবীমা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান সরকারের জাতীয়করণ নীতির প্রতি সমর্থন দেন। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে পদ্মা নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ করে গঙ্গা নদীতে নির্মিত মরণ বাঁধ ফারাক্কা তুলে দেওয়ার দাবিতে ১৯৭৬ সালে ১৬ মে ইন্দিরা গান্ধি সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য ফারাক্কা মিছিল নিয়ে কানসার্ট সীমান্ত পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালের ১ অক্টোবর তার নেতৃত্বে ‘খোদাই খিদমতগার’সংগঠন গঠিত। সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ-বিরোধী আন্দোলনের তিনি ছিলেন লড়াকু নেতা। দেশের সমাজতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম ও বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলনে তিনি ছিলেন কিংবদন্তি তুল্য। তাকে বলা হয়ে থাকে ‘অ্যাফ্রো-এশিয়ার নির্যাতিত মানুষের মুকুটহীন সম্রাট। ভাসানীর প্রকাশিত গ্রন্থ, দেশের সমস্যা সমাধান (১৯৬২), মাও সেতুং-এর দেশে (১৯৭৬)।

মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর মৃত্যুরবণ করেন।


বেগম ফজিলাতুন্নেছাঃ জন্ম ১৮৯৯ সালে টাঙ্গাইল সদর থানার নামদার কুমুল্লী গ্রামে। পিতার নাম ওয়াজেদ আলী খাঁ, মাতা হালিমা খাতুন। তিনি ১৯২১ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক ও ১৯২৩ সালে প্রথম বিভাগে ইডেন কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ফজিলাতুন্নেছা ১৯২৫ সালে কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে বিএ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে গণিত শাস্ত্রে এমএ-তে ফার্স্ট ক্লাশ ফার্স্ট (গোল্ড মেডালিস্ট) হয়েছিলেন। অতঃপর তিনি ১৯২৮ সালে বিলেতে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য গমন করেন। নিখিল বঙ্গে তিনিই প্রথম মুসলিম মহিলা গ্র্যাজুয়েট। উপমহাদেশে মুসলিম মহিলাদের মধ্যে তিনিই প্রথম বিলাত থেকে ডিগ্রি এনেছিলেন। তাঁর পড়াশোনার ব্যাপারে করটিয়ার জমিদার মরহুম ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (চাঁদ মিয়া) বিশেষ উৎসাহ ও অর্থ সাহায্য করেন। বিলেতে তাঁর অবস্থান কালীন সময়ে ভারতীয় মুসলমানদের মাঝে প্রথম ডিপিআই খুলনা নিবাসী আহসান উল্ল্যাহর পুত্র এ এ জোহাও লন্ডনে ব্যারিস্টারী পড়তে যান। লন্ডনে জোহা সাহেবের সাথে ফজিলাতুন্নেছার পরিচয় হয়। পরে উভয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। লন্ডন থেকে ফিরে ১৯৩০ সালে তিনি কলকাতায় প্রথমে স্কুল ইন্সপেক্টরের চাকুরিতে যোগদান করেন। ১৯৩০ সালের আগস্টে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে অনুষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় মুসলিম সমাজ-সেবক-সংঘে’র বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতি হিসেবে তাঁর বক্তব্যটি নারী জাগরণের মাইল ফলক হয়ে আছে। এই অধিবেশনে তিনি বলেন ‘নারী-শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন ও বলেন। নারী সমাজের অর্ধাঙ্গ, সমাজের পূর্ণতালাভ কোনোদিনই নারীকে বাদ দিয়ে সম্ভব হতে পারে না। সেই জন্যেই আজ এ সমাজ এতোটা পঙ্গু হয়ে পড়েছে। তিনি আরো বলেন, The highest form of society is one in which every man and woman is free to develop his or her individuality and to enrich the society what is more characteristic of himself or herself.


কাজেই এ সমাজের অবনতির প্রধান কারণ নারীকে ঘরে বন্দি করে রেখে তার Individuality বিকাশের পথ রুদ্ধ করে রাখা। নারী-শিক্ষা সম্বন্ধে এতোটা কথা আজ বলছি তার কারণ সমাজের গোড়ায় যে-গলদ রয়েছে সেটাকে দূরীভূত করতে না-পারলে সমাজকে কখনই সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারা যাবে না।’ তিনি ১৯৩৫ সালে বেথুন কলেজে গণিতের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। বেথুন কলেজে চাকুরিরত অবস্থায় দেশবিভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে এসে ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন ১৯৪৮ সালে।


বেগম ফজিলাতুন্নেছা ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা ইডেন কলেজের অধ্যক্ষা ছিলেন। বেগম ফজিলাতুন্নেছার অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টায় বিজ্ঞান ও বাণিজ্যিক বিভাগসহ ইডেন কলেজ ডিগ্রি পর্যায়ে উন্নীত হয়। ১৯৫২ সালে ইডেন কলেজের মেয়েরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কলেজের অভ্যন্তর থেকে মিছিল বের করার প্রস্ত্ততি নিলে উর্দুভাষী এক দারোগা হোস্টেলে ঢুকে মেয়েদের ভয়ভীতি দেখাতে শুরু করার এক পর্যায়ে খবর পেয়ে বেগম ফজিলাতুন্নেছা কলেজে এসে তার বিনানুমতিতে কলেজ প্রাঙ্গণে ঢোকার জন্য দারোগাকে ভৎসনা করে হোস্টেল থেকে বের করে দেন নিজের দৃঢ়তা ও প্রশাসনিক ক্ষমতার বলে। নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি সম্পর্কে সওগাতসহ অনেক পত্রিকায় তার বিভিন্ন প্রবন্ধ, গল্প প্রকাশিত হয়।

এই বিদুষী নারী ১৯৭৭ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। এই মহীয়সী নারীর স্মৃতি রক্ষার্থে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৮৭ সালে ফজিলাতুন্নেছার নামে হল নির্মাণ করেন।


যাদুসম্রাট পিসি সরকারঃ ১৯১৩ সালে টাঙ্গাইল শহরতলীর আশেকপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ভগবান সরকার মাতার নাম কুসুম কুমারী সরকার। পিসি সরকার ১৯৩৪ সালে বার্মা, জাপান, সিঙ্গাপুর ও চীনে যাদু প্রদর্শন করে সুখ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৫৭ সালে যাদুকর পিসি সরকার লন্ডনে বিবিসি টেলিভিশনে বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে তরুণী দ্বিখন্ডিত করার খেলাটি প্রদর্শন করেন। খেলাটি টেলিভিশনে দেখেই অনেকে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তাঁর উল্লেখযোগ্য খেলার মধ্যে শূন্যে ঝুলন্ত কঙ্কাল, এক্স-রে চক্ষুর খেলা, জ্যান্ত হাতি অদৃশ্য করা, মোটরগাড়ি অদৃশ্য করা ইত্যাদি উল্ল্যেখযোগ্য।

তিনি ছেলেদের ম্যাজিক, ম্যাজিকের কৌশল, ম্যাজিকের খেলা, সহজ ম্যাজিক, মেসমেরিজম, সম্মোহন বিদ্যা ইত্যাদি সহ ১৮-১৯টি বই লিখেছেন। ১৯৬৪ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করেন। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের নির্দেশে তিনি জাপানে যাদু প্রদর্শন করে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য গঠিত আজাদ হিন্দু ফৌজকে অর্থ সাহায্য করেন। বিশ্বখ্যাত এই যাদুকর ১৯৭১ খ্রি: জাপানের তাবেৎসু (সাপোরো) শহরে মৃত্যুবরণ করেন।

 

ডঃ এমএনহুদাঃ এই পন্ডিত ব্যক্তি (১৯১৯) সালে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে টাঙ্গাইল থানার অন্তর্গত (বর্তমানে দেলদুয়ার থানা) জাঙ্গালিয়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মৌলভী মির্জা আব্দুল করিম। টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী হাই স্কুল থেকে ক্লাসের ফার্স্টবয় হিসাবে চারটা লেটার ও স্টার পেয়ে দশ টাকা করে মাসিক বৃত্তি পেয়ে ১৯৩৫ সালে মেট্রিক পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪০ সালে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে অনার্স পাশ করেন। তিনি ঐ বছর অনুষ্ঠিত সর্ববিষয়ে অনার্স গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে প্রথম হওয়াতে তৎকালীন দুর্লভ বৃত্তি রাজা কালিনারায়ন স্কলারশীপে ভূষিত হন। তিনি প্রথম মুসলিম ছাত্র, যিনি এই দুর্লভ কৃতিত্বের অধিকারী হন। অতঃপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হন। মরহুম তমিজ উদ্দিন খান কলিকাতাতে প্রাদেশিক মন্ত্রী ছিলেন। তমিজ উদ্দিন খানের দ্বিতীয় কন্যা কুলসুমের সঙ্গে তিনি ঐ সময় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ২৬.০১.১৯৪৫ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকুরি শুরু করেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকুরিকালীন অবস্থাতেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারতীয়দের জন্য বেশ কিছু ওভারসীজ বৃত্তির ঘোষণা পত্রিকা মাধ্যমে প্রচার করেন। ডঃ এমএন হুদার বৃত্তির জন্য দরখান্ত করেন এবং নির্বাচিতও হন। ওভারসীজ স্কলারশীপ নিয়ে ডঃ এমএন হুদা ১৯৪৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৯ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনোমিকসের রিডার হিসাবে যোগদান করেন। ডঃ হুদা ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসাবে যোগদান করেন এবং তিনি এই পদে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত অধিষ্ঠিত ছিলেন। এরপর ১৯৬৯ সালের ৩ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদে নিযুক্ত হয়ে শপথ গ্রহণ করেন। কিন্তু ২৫ মার্চ দ্বিতীয় সামরিক অভ্যুত্থানে জেনালে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং ডঃ হুদার গভর্নরের কার্যকাল শেষ হয়ে যায়। ডঃ হুদা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক পদে চলে যান।

১৯৭৫-এর ২৬ নভেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার সাথে যুক্ত থাকেন, অতঃপর প্রেসিডেন্ট সায়েম তাকে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ করে পরিকল্পনা বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছাড়াও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কিছু দায়িত্বও অর্পণ করেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে তিনি মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও প্রেসিডেন্ট সাত্তারের আমলে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯১ সালের ২২ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

  

আবদুস সাত্তারঃ কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, ভাষাবিদ, অনুবাদক, স্মৃতিকথক, সম্পাদক, শিশুতোষ সাহিত্য রচয়িতা আবদুস সাত্তার ১৯২৭ সালে ২০ জানুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার গোলরা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম মৌলভী আবদুস সোবহান, মাতা সবির উন-নেসা। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা শতস্পর্শী। ১৯৪৩ সালে ‘দৈনিক আজাদ’পত্রিকার ‘মুকুলেরর মহফিলে’-র পাতায় প্রথম ছড়া প্রকাশিত হয়। ১৯৪৫-এ ‘মাসিক মোহাম্মদী’-তে প্রথম কবিতা। এরপর থেকে লেখায় বিরাম পড়েনি। নিজের সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, .... আমাকে কিছু না কিছু লিখতেই হবে। .... লেখা আমার অস্থিমজ্জার সঙ্গে জড়িত। আমার লেখা প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে। তারপর আরও অনেকগুলো। ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয় আদিবাসীদের নিয়ে গবেষণাগ্রন্থ ‘অরণ্য জনপদে’। বাংলাদেশের উপজাতিদের নিয়ে লেখা এটিই একমাত্র পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। বইটি জাতীয় সাহিত্য পুরস্কার ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র পুরস্কার অর্জন করেছে। আবদুস সাত্তার ২০০০ সালের মার্চ মাসে বার্ধক্যজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করেন।

 

আব্দুল মান্নানঃ আব্দুল মান্নানের জন্ম ১৯২৯ সালে ৭ অক্টোবর টাঙ্গাইল সদর উপজেলার গলাটিয়া গ্রামে। বাবা তাজ উদ্দিন জোয়ারদার, মা খাতুন জোয়ারদার। গত ৫৯ বছর ধরে দেশের রাজনীতির উত্থান-পতনের ঘটনাবহুল সময়ের সাক্ষী তিনি। আব্দুল মান্নান ১৯৪৮ সালে তৎকালীন টাঙ্গাইল মাহফিল (বর্তমান টাঙ্গাইল জেলা সমিতি)-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৫ সালে টাঙ্গাইল মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং পরবর্তী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ও ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে তার ভূমিকা উজ্জ্বল। ১৯৭০ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে এমএনএ নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল মুজিব নগর সরকারের মন্ত্রী পরিষদের বৈঠকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় আব্দুল মান্নানকে স্বাধীন বাংলা বেতর কেন্দ্রের প্রচার বিভাগের দায়িত্ব দেন। ১৯৭১ এ স্বাধীনতা যুদ্ধে মাটি থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করার জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ পরিচালনা করে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ, উদ্দীপনা, সাহস ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আহম্মদ রফিক ছদ্মনামে তিনি ‘বহুবন্ধুর বিচার প্রহসন নামক নিয়মিত কথিকা পাঠ করতেন। যা পাক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর বিচারের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত গঠনে সহায়তা করে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুজিব নগর থেকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক জয়বাংলা নামে একটি পত্রিকা প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সম্পাদনায় বের হতো। ১৯৭৪ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৯৬ সালে তৃতীয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক দেশের নন্দিত এই রাজনীতিবিদ ২০০৫ সালের ৪ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।

 

অতুল চন্দ্র গুপ্তঃ জন্ম ১০.০৫.১৯৮৪ সালে সাকরাইলে। লেখক, আইনজীবী এবং রাজনীতিক। ১৯০৬ সালে দর্শন বিষয়ে প্রথম শ্রেণীতে এমএ পাশ করেন। আইনজীবী হিসেবে কলিকাতা হাইকোর্টে যোগ দেন ১৯১৪ সালে। ১৯১৮ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ছাত্র জীবন থেকেই প্রগতিশীল রাজনীতি করতেন। রসতত্ত্বে ও অলংকার শাস্ত্রের ওপর ব্যুপত্তি তাঁর অসাধারণ। তাঁর ‘কাব্যজিজ্ঞাসা’গ্রন্থটি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে পাঠ্য। অন্যান্য গ্রন্থ : ১. শিক্ষা ও সততা ২. জমির মালিক ৩. সমাজ ও বিবাহ ৪. নদী পথে ৫. ইতিহাসের মুক্তি ইত্যাদি। তাঁর উপার্জিত অর্থের বৃহৎ অংশ জনসেবামূলক কাজে ব্যয় করেছেন। মৃত্যু ১৭.০২.১৯৬১ সালে।

 

জাহ্নবী চৌধুরানীঃ জাহ্নবী চৌধুরানী মাত্র ১৩ বছর বয়সে স্বামী গোলকনাথ রায় চৌধুরীর মৃত্যুতে বিধবা হয়ে সন্তোষ ছয় আনী জমিদারির মালিকানা লাভ করেন। তিনি মজিদারি পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন জনহিতকর কাজেও যথেষ্ট অবদান রাখেন। তিনি ৩ জুন ১৮৭০ সালে তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার দ্বিতীয় ইংরেজি (এমই) বিদ্যালয় হিসেবে সন্তোষ জাহ্নবী হাইস্কুল স্থাপন করেন। এই বিদ্যালয় থেকে ১৮৯৬ সালে মহিম চন্দ্র ঘোষ এন্ট্রাস পরীক্ষায় প্রথম স্থান, ১৯২৬ সালে দেবেন্দ্র নাথ ঘোষ মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান, ১৯৬৫ সালে ঢাকা বোর্ড থেকে নিতাই দাস পাল এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম স্থান এবং ১৯৬৯ সালে আশীষ কুমার পাল এসএসসি মানবিক বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। জাহ্নবী চৌধুরানী জনস্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ রেখে সন্তোষে নিজ বাড়ির আঙি্নায় স্বামীর নামে গোলকনাথ দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

 

রানী দিনমনি চৌধুরানীঃ সন্তোষ ছয়আনী জমিদারির কর্তা জাহ্নবী দেবী চৌধুরানীর পোষ্যপুত্র বৈকুণ্ঠনাথ চৌধুরীর স্ত্রী ছিলেন দিনমনি চৌধুরানী। তাঁর উল্লেখযোগ্য জনহিতকর কাজ হচ্ছে ১) দার্জিলিং শৈলবাসে স্বামীর নামে বৈকুণ্ঠনাথ থাইসিস ওয়ার্ড স্থান (২) ঢাকায় বৈকুণ্ঠনাথ আশ্রম নির্মাণ (৩) ঢাকা মিটফোর্ড কলেজে মহিলাদের জন্য ওয়ার্ড নির্মাণ (৪) কাগমারীতে মৃতদেহ সৎকারের জন্য দাতব্য কাষ্ঠ ভান্ডার স্থাপন। এছাড়াও তিনি ঢাকার জগান্নাথ কলেজকে পাঁচ হাজার ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অর্থ সহায়তা দেন। ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে তিনি রানী উপাধি পান।

 

আবু কায়সারঃ জন্ম ১২.০২.১৯৪৫ সালে পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিবাদের জিয়াগঞ্জে। বাবা শফিউদ্দিন আহমেদ, মা শামসুন নাহার। পৈত্রিক নিবাস মীরের বেতকা গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক। কর্মজীবনে বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন। গদ্যে পদ্যে সিদ্ধহস্ত। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : ১. আমি খুব লাল একটি গাড়িকে (কবিতা) ২. লজ্জার দেরাজ (কবিতা) ৩. সব পাখি আসে (উপন্যাস) ৪. পলি মাটির পুতুল (শিশুসাহিত্য) ৫. রায়হানের রাজহাঁস (শিশুসাহিত্য) ৬. যাদু সম্রাট পি.সি. সরকার (জীবনী) ৭. বুলগেরিয়ার গল্প (অনুবাদ)। ২০০৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

 

কামাক্ষা নাথ সেনঃ জন্ম ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ সালে টাঙ্গাইল শহরে। পিতা প্রিয়নাথ সেন, মাতা প্রভাবতী সেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমকম (হিসাববিজ্ঞান) ১৯৭৪, এমকম (ফিন্যান্স) ১৯৭৫, এলএলবি ১৯৭৬। তিনি একাধারে আইনবিদ, লেখক, সম্পাদক, সংগঠক ও অধ্যাপক ছিলেন। তিনি টাঙ্গাইল আইন মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়, ইন্সটিটিউট অব্ ব্যাংকার্স ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলর পরীক্ষক ছিলেন। কামাক্ষা নাথ সেন বাংলাভাষায় প্রথম আইন বিষয়ক পত্রিকা ত্রৈমাসিক ‘আদালত’- এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তাঁর বিশেষ কিছু গ্রন্থ হলো : ১. অগ্রক্রয় আইন ২. শত্রু সম্পত্তি আইন ৩. তামাদি আইন ৪. মুসলিম আইন ৫. নিষেধাজ্ঞা আইন ৬. হিন্দু আইন ৭. জামিন আইন ৮. ছানী মামলার আইন ৯. বাটোয়ারা আইন। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ হলো, ষাটের দশকের কবিতা (মাহমুদ কামালের সঙ্গে যৌথ) ও সত্তর দশকের কবিতা (মাহমুদ কামালের সঙ্গে যৌথ)। কামাক্ষা নাথ সেন ৩০ মার্চ ২০০৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

 

গোপিনাথ কবিরাজ, মহামহোপাধ্যায়ঃ জন্ম ১৮৮৭ সালে সদর থানার দাইন্যা গ্রামে। কাশীর কুইন্স কলেজ থেকে সংস্কৃতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন এবং ঐ কলেজেই সংস্কৃতের অধ্যাপক ও গ্রন্থগারিক হন। ১৯১৮ সালে বিখ্যাত তান্ত্রিক ও দার্শনিকযোগী বিশুদ্ধানন্দের কাছে দীক্ষা নেন। তাঁর অসাধারণ বুৎপত্তি ছিলো দর্শনের সমস্ত শাখায়, বিশেষত ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র ও বৌদ্ধ দর্শনে। ১৯৬৪ সালে ভারত সরকার তাঁকে মহামহোপাধ্যায়, ১৯৪৭ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় ডি.লিট. ১৯৬৪ সালে পদ্মভূষণ, ১৯৬৫ সালে উত্তর প্রদেশ সরকার সাহিত্য বাচস্পতি এবং ১৯৭৬ সালে বিশ্বভারতী তাঁকে ‘দেশীকোত্তম’উপাধি দেন। বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় তাঁর রচিত প্রধান প্রধান গ্রন্থাবলী ১. শ্রী শ্রী বিশুদ্ধানন্দ প্রসঙ্গ (৫খন্ড) ২. ভারতীয় সাধনার ধারা ৩. শ্রী কৃষ্ণ প্রসঙ্গ ৪. তান্ত্রিক সাধনা ৫. মৃত্যু বিজ্ঞান ও কর্ম রহস্য ৬. SARASWATI BHAWAN STUDIES ৭. ASPECTS OF INDIUN THOAGHT এবং সংস্কৃতে ৮. ত্রিপুরা রহস্য ৯. গোরখ সিদ্ধান্ত সংগ্রহ প্রভৃতি। ১৯৭৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

 

নরেশ গুহঃ জন্ম ১৯২৪ সালে টাঙ্গাইল সদর। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ : ১. দুরন্ত দুপুর (কাব্য) ২. তাতার সমুদ্র ঘেরা (কাব্য) ৩. ‘W.B. Yeats : An Indian’(সমালোচনা) বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’(১৯৩৫) পত্রিকার সহ-সম্পাদক ছিলেন।

 

নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্তঃ ৩ মে ১৮৮২ সালে বগুড়ায় মাতুলালয়ে জন্ম। তাঁর পৈত্রিক নিবাস টাঙ্গাইলে। তিনি একাধারে আইনবিদ, গবেষক ও লেখক ছিলেন। ১৯০৫ সালে দর্শন সাস্ত্রে এমএ পাশ করেন। ১৯০৬ সালে ওকালতি পাশ করে কলিকাতা হাইকোর্টে যোগ দেন ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আইন কলেজে অধ্যাপনা করেন এবং সে সময় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে ও কংগ্রেসের রাজনীতিতে অংশ নেন। প্রাচীন ভারতের ব্যবহার ও সমাজনীতি বিষয়ে গবেষণা করে ১৯২০-২৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের অধ্যাপনা করেন। ইউনেস্কোর আমন্ত্রণে ১৯৫১ সালে আমেরিকায় অনুষ্ঠিত অধিবেশনে যোগ দেন। ১৯৫৬ সালে ভারতীয় আইন কমিশনের সদস্য ছিলেন। সাহিত্যিক হিসাবেও তাঁর বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। তাঁর একাধিক উপন্যাস চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে। ১৯৩৪ সালে লেবার পার্টি অব ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ৬০টি গ্রন্থের রচয়িতা। আইন ও সাহিত্য উভয় দিকের রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। গ্রন্থ : গল্প উপন্যাস : ১. শুভা, ২. পাপের ছাপ, ৩. অগ্নি সংস্কার, ৪. শান্তি, ৫. দত্ত গিন্নী, ৬. কাঁটার ফুল ইত্যাদি। নাটক : ১. আনন্দ মন্দির, ২. ঠকের মেলা, ৩. ঋষির মেয়ে ইত্যাদি। ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

 

প্রমথনাথ রায় চৌধুরীঃ জন্ম ১৮৭২ সালে সন্তোষের জমিদার পরিবারে। তিনি কবি, নাট্যকার হিসেবে বিখ্যাত। ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর ভালো দখল ছিলো। স্বদেশী আন্দোলনে যথেষ্ট অবদান রাখেন এবং নাটোরের মহারাজার সঙ্গে একত্রে ‘সাহিত্য সঙ্গীত’নামক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। প্রবাসী, মানসী, ভারতবর্ষ, প্রদীপ, সাহিত্য প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর অত্যন্ত হৃদ্যতা ছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নামে কণিকা কাব্য এবং তিনি রবীন্দ্রনাথের নামে ‘পদ্ম’কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেন। প্রমথনাথ রায় চৌধুরী জলধর সেনের সম্পাদনায় ‘প্রমথ নাথের গ্রন্থাবলী’নামে কয়েক খন্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর গ্রন্থগুলো হলোঃ ১. পদ্ম, ২. দিপালী, ৩. গীতিকা, ৪. আরতি, ৫. গৌরাঙ্গ ইত্যাদি। নাটকঃ ১. ভাগ্যচক্র, ২. চিতোরোদ্ধার বা হাম্বির, ৩. জয় পরাজয় ইত্যাদি নাটক। প্রহসালঃ আক্কেল সেলামী। তিনি ১৯৪৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

 

বস্কিম চন্দ্র সেনঃ জন্ম ১৮৯২ সালে সদর উপজেলার ঘারিন্দা গ্রামে। কবি, প্রবন্ধকার ও সাংবাদিক। কলিকাতায় গিয়ে ১৯১৭ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৩০ সালে আনন্দ বাজার পত্রিকার সম্পাদক গ্রেপ্তার হলে তিনি ৭ মাস পর্যন্ত অস্থায়ী সম্পাদক ছিলেন। ‘দেশ’পত্রিকা প্রকাশিত হলে তিনি তার সম্পাদক হন ১৯৩৩ সাল। ১৯৪২ সালে আইন অমান্য আন্দোলনের সমর্থনে প্রবন্ধ লেখার জন্য গ্রেপ্তার হন। ১৯৪৪ সালে থেকে ভগবৎ সাধনায় অনুরাগী হয়ে বিভিন্ন স্থানে বৈষ্ণব শাস্ত্র ও ধর্ম বিষয়ে বক্তৃতা দিতেন। সে সময় বৈষ্ণব ধর্মের উপর কয়েকটি গ্রন্থও রচনা করেন। ১৯৫৮ সালে ‘দেশ’পত্রিকা থেকে অবসর নেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ : ১. গীত মাধুরী, ২. লোকমাতা রানী রাসমনি, ৩. জীবন-মৃত্যুর সন্ধিস্থলে প্রভৃতি। ১৯৬৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

 

ভবানী প্রসাদঃ জন্ম ষোড়শ শতকের কাঠালিয়া (প্রাচীন আতিয়া পরগণা) গ্রামে। তিনি ছিলেন জন্মান্ধ এবং শৈশবেই পিতা মাতাকে হারিয়েছিলেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ : দুর্গামঙ্গল, ২. মনসা মঙ্গল। ব্যোমকেশ মুস্তাফীর সম্পাদনায় ১৩২১ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক দুর্গামঙ্গল প্রকাশিত হয়। দুর্গামঙ্গল মার্কন্ডেয় চন্ডীয় অনুবাদ, তবে মুলানুগ অনুবাদ নয়। অন্যান্য পুরাণের প্রভাব আছে। সপ্তদশ শতকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

 

রসিক চন্দ্র বসুঃ ঊনিশ শতকে নাগরপাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করে। আতিয়া পরগণার জমিদার প্রখ্যাত জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত করটিয়ার সাহিত্যিক পরিমন্ডলের ত্রিরত্নের অন্যতম (রসিক চন্দ্র বসু, ছাবেদ আলী খাঁ ও মোসলেমউদ্দিন খাঁ)। তিনি বিশিষ্ট কবি, ইতিহাসবেত্তা ও লেখক ছিলেন। আতিয়া পরগণার ইতিহাসমূলক গ্রন্থ : ‘আতিয়ার ইতিহাস’তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান। এ গ্রন্থের মাধ্যমে টাঙ্গাইলের সাবেকি অবস্থার একটি চিত্র পাওয়া যায়। তাঁর রচিত অন্যান্য গ্রন্থ : ১. সৈয়দ খাঁ, ২. শেরশাহ, ৩. শৈব্যা, ৪. দময়ন্তী, ৫. বেহুলা ইত্যাদি। তিনি বিশ শতকের প্রথম ভাগে মৃত্যুবরণ করেন।

 

অনুথবন্ধু গুহঃ ১২৫৫ বাঃ ময়মনসিংহ শহরে তাঁর জন্ম। পিতা মৃত্যুঞ্জয় গুহ। তাঁর পৈত্রিক নিবাস সদর থানার বেলতা গ্রামে। আইনজীবী, সমাজসেবী ও শিক্ষানুরাগী। ময়মনসিংহ থেকে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ওকালতি শুরু করেন। ‘ভারত মিহির’সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করতেন ১৮৭৫ সালে। স্থানীয় সৌরভ, চারুবার্তা, বাঙালি ও চারুমিহির পত্রিকা প্রকাশে তার যথেষ্ট অবদান ছিল। শিক্ষা বিস্তার, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, বিধবা বিবাহ প্রবর্তন প্রভৃতি কাজে অংশ নেন। তিনি ময়মনসিংহে পিতার নামে ‘মৃত্যুঞ্জয় হাই স্কুল’এবং কাশীতে মাতার নামে ‘জগদ্বম্বী জাতীয় আয়ুর্বেদ মহিলা বিদ্যালয়’স্থাপন করেন। কাশীতে তাঁর ১৩৩৪ বাঃ মৃত্যু হয়।

 

অমরেন্দ্রনাথ ঘোষঃ ২ অগ্রহায়ণ ১২৮১ বাঃ, টাঙ্গাইল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সাহচর্যে আইন ব্যবসা ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দেন। যুগান্তর ও স্বরাজ্য দলের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি টাঙ্গাইল পৌরসভার চেয়ারম্যান এবং বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের স্বরাজ দলের ডেপুটি চীফ হুইপ ছিলেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে সক্রিয় অবদান রেখেছেন। তাঁর মৃত্যু ১০ পৌষ ১৩৫০ বাঃ।

 

রূপনারায়ণ ঘোষঃ ষোড়শ শতাব্দীর কবি রূপনারায়ণ ঘোষ ১৫৯৭ সালে আদাজান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর রচিত ‘দুর্গামঙ্গল’কাব্য সাধারণ্যে ‘প্রাকৃত চন্ডী’নামে পরিচিত। কবি ভবানী প্রসাদের চেয়ে এ কাব্য সবদিক থেকেই উন্নত।

 

মোসলেমউদ্দিন খানঃ কবি মোসলেমউদ্দিন খান ১৮৬২ সালে গান্দিনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ‘হিতকরী’পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ‘বুলবুলিস্তান’ও ‘হিতকাব্য’তাঁর রচনা। ১৯৩৪ সালের ২ অক্টোবর টাঙ্গাইল শহরের থানাপাড়ার বাসগৃহে ৭২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

 

সৈয়দ রেদওয়ানুর রহমানঃ ১৯২৫ সালে বানিয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলো হচ্ছে : রেডিও টেলিভিশনের কথা (অনুবাদ ১৯৫৯) আজব বাপ (অনুবাদ ১৯৬৩) চল্লিশজন সেরা বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে আল্লাহর অস্তিত্ব(অনুবাদ ১৯৬৩) নামাজ ও আদর্শ নাগরিক (অনুবাদ ১৯৬৪) রক্তের লেখা ইতিহাস (১৯৬৪), তুমি সুন্দর (১৯৬৭), রাজা মিঞার রাজবাড়ী (১৯৬৯) ইত্যাদি।

 

কুমুদিনী মিত্রঃ ‘সঞ্জীবনী’পত্রিকার সম্পাদক কৃষ্ণকুমার মিত্রের কন্যা কুমুদিনী মিত্র (পরে বসু উপাধি নামের শেষে ব্যবহার করেন) তিনি সদর থানার বাঘিল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এ জেলার প্রথম গ্রাজুয়েট মহিলা। তাঁর গ্রন্থসমূহ : শিখের বলিদান, জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী, মেরী কার্পেন্টার, সমাধি ইত্যাদি।

 

মীর আবুল খায়েরঃ জন্ম ৮ পৌষ ১৩৪২ বঙ্গাব্দ। একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবি ছিলেন। তিনি ‘সমুদ্রে ঝিনুক’নামে একটি কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা। বাংলা ১৩৬৮ সালের ৫ ফাল্গুন মৃত্যুবরণ করেন।

 

তারাপদ রায়ঃ ১৯৩৯ সালে পূর্বআদালত পাড়া, টাঙ্গাইল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সচিব হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন। বিখ্যাত এই লেখকের উল্লেখযোগ্য বই : তোমার প্রতিমা, নীল দিগন্তে এখন ম্যাজিক, কোথায় যাচ্ছেন তারাপদ বাবু, রস ও রমণী ইত্যাদি। তিনি ২০০৭ সালের ২৫ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।

 

ব্যারিস্টার শওকত আলী খানঃ জন্ম ০৯-০২-১৯২৬ সালে দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটী গ্রামে। পিতা ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আরফান খাঁন। লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারী পাস করে হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তিনি ১৯৭০ সালে নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক হিসেবে ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ রাতে ব্যারিস্টার শওকত আলী খান বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যান। সেখানে আলোচনার পর বঙ্গবন্ধু তাকে নিজ এলকায় যাওয়ার নির্দেশ দেন। ১৯৭১ এ ২৪ মার্চ ব্যারিস্টার শওকত আলী খান নিজ গ্রাম লাউহাটীতে চলে আসেন। তিনি একজন সংসদ সদস্য হয়েও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭১-এর আগস্ট মাসে ভারতের মহেন্দ্র গঞ্জের মাইনারচর থেকে তিনি সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে গেরিলা বাহিনীর একটি কোম্পানিসহ দেশের ভেতরে আসে যুদ্ধের জন্য। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে তিনি সংবিধান রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সহ-সভাপতি ছিলেন। আমৃত্যু তিনি রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২৯-০৬-২০০৯ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন।

 

রায় বাহাদুর সতীশ চন্দ্র চৌধুরীঃ জন্ম ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। জমিদার ও সমাজসেবক। সতীশবাবু ৫৪ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত বাড়ি থেকে জমিদারি পরিচালনা করতেন। বাড়ির একেবারে দক্ষিণে রয়েছে ১১ একর জমির উপর খননকৃত বিশাল আকৃতির এক জলাশয়। বাংলা ১৩৪১ সনে খননকৃত জলাশয়ের নাম উপেন্দ্র সরোবর। উল্লেখ্য উপেন্দ্র সরোবর সতীশ বাবুর পিতার নাম। সতীশবাবু স্থাপন করেন নাগরপুর যদুনাথ হাই স্কুল। তাঁর বাড়িতেই বর্তমানে নাগরপুর মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি প্রজাকল্যাণে বাড়ির অদূরে নির্মাণ করেন বৃহৎ হাসপাতাল। এই হাসপাতালের চিকিৎসক অক্ষয়বাবু, ননীগোপাল দত্তের সেবার কথা আজও মানুষ স্মরণ করে। মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত এটি তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার পল্লী অঞ্চলের সর্ববৃহৎ চিকিৎসা কেন্দ্র। জনসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাঁকে রায় বাহাদুর খেতাবে ভূষিত করেছিলেন। খেলাধুলার উদার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সতীশবাবুর খ্যাতি আজও ম্লান হয়ে যায়নি। সতীশবাবু ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মৃত্যুবরণ করেন।