টাঙ্গাইল শাড়িঃ
‘‘নদীচর খাল-বিল, গড়ারীর বন
টাঙ্গাইল শাড়ি তার গরবের ধন।’’
প্রকৃতপক্ষে টাঙ্গাইল শাড়ি জেলার গর্বের বস্ত্ত। টাঙ্গাইলের শাড়ির কদর দেশ জোড়া। এক সময় বাংলাদেশের খ্যাতি ও গৌরব ছিল মসলিন এবং জামদানিরজন্য। তন্মধ্যে জামদানি টিকে থাকলেও মসলিন শুধু এখন ইতিহাসের সামগ্রী। তবে মসলিন ও জামদানির পর বাংলাদেশের বস্ত্র খাতে টাঙ্গাইল শাড়ি নতুনমাত্রা যোগ করতে সক্ষম হয়েছে। টাঙ্গাইল শাড়ির নক্সা, বুনন ও রঙের ক্ষেত্রে রয়েছে ব্যাপক বৈচিত্র্য। টাঙ্গাইল শাড়ি আজ দেশের সীমানা পেরিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এমনকি ইউরোপ, আমেরিকা এবং জাপানেও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এবং করছে। উৎপাদনের সাথে জড়িত শ্রমিক তাঁতিদের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী টাঙ্গাইল জেলার ১২টি থানার মোট ৩৪,৬৭৮টি তাঁতে বর্তমানে প্রায় ৭৬ হাজার তাঁতি টাঙ্গাইল শাড়ি উৎপাদনের কাজে জড়িত রয়েছে। উল্লেখিত তাঁতের মধ্যে বর্তমানে প্রায় ৭ হাজার তাঁত বন্ধ রয়েছে।
টাঙ্গাইল শাড়ির সাথে সংশ্লিষ্ট তাঁতিগণের প্রায় কারোরই কোন পেশাগত প্রশিক্ষণ নেই। তা সত্ত্বেও শাড়ির বুননের ক্ষেত্রে এদের দক্ষতা ও নৈপূণ্য রীতিমতো বিস্ময়কর। টাঙ্গাইল শাড়ির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এর সুষ্ঠু বিপণন ব্যবস্থার অনুপস্থিতি। বাজারে এ-শাড়ির যথেষ্ট চাহিদা থাকলেও বিপণন ব্যবস্থাটি মহাজনি চক্রের হাতে বন্দি। মসলিনের প্রায় সমতুল্য সূক্ষ্ম ও উন্নত ধরণের শাড়ি এখনও টাঙ্গাইলের শিল্পীরা তৈরি করতে পারেন। টাঙ্গাইলের হিন্দু তাঁতিদের মৌলিক উপাধি বসাক। বাজিতপুর, নলশোধা, পাথরাইল গ্রামে এরা সংখ্যাধিক্য। কালিহাতীর বল্লা, রতনগঞ্জ মুসলিম কারিগর সংখ্যায় সহস্রাধিক। স্বাধীনতার পর ইদানীং টাঙ্গাইল শাড়ি তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেয়েছে।
এক সময় শোনা যায় টাঙ্গাইলে মসলিন শাড়িও তৈরি হতো। মসলিন নামে উৎপত্তি নিয়ে মতদ্ধৈতা আছে। কারো কারো মতে ‘মসলি পত্তন’ থেকে বিদেশী বণিকগণ ইউরোপে এ-বস্ত্র চালান দিত বলে এর নাম করা হয় মসলিন। খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে হামদ বা পর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচারে বঙ্গোপসাগর দিয়ে বিদেশে এখানকার বস্ত্র চালানোর অসুবিধার দরুন তুরস্কের তদানীন্তন রাজধানী ‘মোসলে’ নগরের তন্তুবায় সম্প্রদায় এখানকার বস্ত্র-শিল্পের অনুকরণে এক প্রকার কাপড় তৈরি করে এবং সেই ‘মোসলে’ নাম থেকেই ‘মসলিন’ নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকের বিশ্বাস। ধ্বংসের তান্ডবলীলায় মসলিন আজ অবলুপ্ত হয়েছে।
টাঙ্গাইল শাড়ি ছাড়া টাঙ্গাইলের বিভিন্ন গ্রামে যেমন, আদি টাঙ্গাইল, পাথরাইল, নলশোধা, আকদ, ঘারিন্দা, ছাতিহাটি, গোলরা, রামপুরা, জোয়াইর, মোমিননগর, করটিয়া প্রভৃতি এলাকায় মোটা বস্ত্র তৈরি হয়। এ-সব কাপড়ের রং পাকা এবং মজবুত। শাড়ি ছাড়াও টাঙ্গাইলের লুঙ্গি, গামছা ইত্যাদি তৈরি হয়।
টাঙ্গাইল জেলার কুটির শিল্প বলতে বর্তমানে তন্তুবায়ীদের বোঝায়; যারা হিন্দু সম্প্রদায়ের তাদেরকে তাঁতি এবং যারা মুসলিম সম্প্রদায়ভূক্ত তাদের জোলা বা কারিগর বলা হয়ে থাকে।
তামা-কাঁসা শিল্পঃ
লৌহ, তামা, পিতল, কাঁসা, স্বর্ণ ও রৌপ্য ইত্যাদি ধাতু নিয়ে যাদের জীবিকা তাদের কর্মকার বলা হয়ে থাকে। ধাতুশিল্পের দিক দিয়েও টাঙ্গাইল জেলা এক সময় প্রসিদ্ধ ছিল। এখানে অনেক স্বর্ণকার ও কর্মকার ছিল। স্বর্ণকাররা বিবিধ ধরণের অলংকার তৈরি করত। বারাতির কর্মকারেরা রকমারি পিতলের জিনিসপত্র এবং কাগমারী ও মগরার কর্মকারেরা কাঁসার জিনিসপত্র তৈরি করত। টাঙ্গাইলের কালিহাতী, ঘাটাইলের পাকুটিয়া গ্রামের কর্মকার শ্রেণী আজো লৌহজাত শিল্প দ্রব্য তৈরিতে তাদের দক্ষতা সুপ্রমাণিত। কাগমারীর ও মগড়ার কাঁসার বাসন-কোসন ছিল ভারত-বিখ্যাত। এক সময় এ-ব্যবসা ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী। দেশ ভাগ হওয়ার পর এই শিল্পের শত শত দক্ষ পরিবার ভারতে পাড়ি দিয়েছে। টাঙ্গাইলের কাগমারী, মগড়া এই দুটি গ্রামে অনেক কর্মকার পরিবার বাস করে। এদের হাতে কাঁসার বাসন ছাড়াও তামা-পিতলের বাসন-কোসন তৈরি হয়। এগুলো যেমন কারুকার্যময় তেমনি টেকসই। কাগমারী ও মগড়া গ্রামের কর্মকাররা এখনো তৈরি করে পিতলের কলসি, জগ, ঘটি, বদনা, লোটা, থালা, গ্রাস, বোল, ডেকচি, চামচ, খুন্তি,কাঁসার ঘন্টা, বাটি, পুষ্পাধার প্রভৃতি। বাদ্যযন্ত্র যেমন করতাল, ঝুনঝুনি ইত্যাদিও এখানে তৈরি হয়। বর্তমানে পিতল-কাঁসার, কাঁচামাল অর্থাৎ রং , তামা ও দস্তার উচ্চ মূল্য ও দুস্প্রাপ্যতার কারণে এ মূল্যবান ও ঐতিহ্যবাহী শিল্প ধ্বংসের মুখে। সমবায়ের মাধ্যমে এই শিল্পের উন্নয়নের প্রচেষ্টা নেয়া হলেও তেমন ফল লাভ হয়নি। কাঁসা পিতল শিল্পের উন্নয়নে প্রচুর কাঁচামাল সরবরাহ আধুনিক মেশিনারির ব্যবস্থা এবং সেই সাথে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী আধুনিক রুচিসম্মত জিনিসপত্র তৈরির ব্যবস্থা করা দরকার।
মৃৎ শিল্পঃ
মাটি আর মানুষ আমাদের বড় সম্পদ। এ সত্যের প্রকাশ ঘটেছে টাঙ্গাইলের মৃৎশিল্পে। টাঙ্গাইলের এঁটেল মাটির তৈজসপত্র দ্রব্যাধার পুতুল ও দেবদেবীর বিগ্রহ দেখতে সুন্দর, কাজে টেকসই। গবাদি পশুর সম্মুখে যে পাত্রে খাওয়া দেওয়া হয় তার নাম চাড়ি। টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থানে এটি তৈরি হয়। এছাড়া মটকি বা কোলা বা বিশাল বপু পাতিল তৈরি হয় টাঙ্গাইলের বিভিন্ন কুমার পাড়ায়। পোড়া মাটির টালি এক সময় এখান থেকে গোটা ময়মনসিংহ জেলায় চাহিদা মেটাত। ফুলের টব ও পাতা-কুয়ার মাটির পাট তৈরিতেও টাঙ্গাইলের কুমার সম্প্রদায় সুদক্ষ। গোপালপুর থানার সূতী, ডুবাইল, বাগুয়াটা, কালিহাতীর বল্লা, টাঙ্গাইল সদরের করটিয়া, গালা, মির্জাপুরের জামুর্কী, মধুপুরের ধনবাড়ীসহ বিভিন্ন স্থানের কুমররা আজো শিল্প নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়ে আসছে। মাটির তৈজসপত্র, সানকি, হাড়ি, সরা, বাটি, পিঠা তৈরির ছিদ্রযুক্ত পাতিল। দইয়ের ঠিলা, কোলা, গুড়ের মটকি প্রভৃতি টাঙ্গাইলের কুমারদের অনবদ্য সৃষ্টি। এসব মাটির জিনিসপত্র সাধারণত বিভিন্ন হাট-বাজার ও মেলায় বিক্রি হয়। ফেরি করেও বিক্রি করা হয়। টাঙ্গাইলের কুমারদের মধ্যে অনেকে প্রতিমা নির্মাণে সিদ্ধহস্ত। এছাড়া ঘোড়া, গরু, বাঘ, হাতি, কুকুর, মাছ, আম, কাঁঠালসহ নানা ধরণের খেলনা শিশুদের মনোরঞ্জন করতে সক্ষম হয়। টাঙ্গাইলের এই শিল্পের উন্নয়নে আজো কিছু করা হয়নি। আদিমকালের সাজ সরঞ্জাম দিয়ে কুমাররা এখনো কাজ করে যাচ্ছেন।
বাঁশ ও বেত শিল্পঃ
টাঙ্গাইলের বাঁশ ও বেতশিল্পেরও রয়েছে একটি সুপ্রাচীন ইতিহাস। বাঁশ দিয়ে শুধু বাঁশি তৈরি হয়নি। এদিয়ে তৈরি হয়েছে নানাবিধ উপকরণ। টাঙ্গাইলের বেতঝোপ থেকে বেত কেটে এনে হাতের গুণে তৈরি করা হয় নানা প্রকার ব্যবহারযোগ্য জিনিস। বেতের ডালিয়া, ধান চাউলের বেড় ও তিল তিসি, সরিষা রাখার ছোট বড় ডুলি। বাটখারা প্রচলনের পূর্বে পাঁচসেরি মুনকা বা ধামার ব্যবহার ছিল। এখনো গ্রামাঞ্চলে ব্যবহৃত হয়। বাঁশের চটি দিয়ে তৈরি হয় ডালি, চাটাই, ধাড়ি, কাইত্যা, বেড়, ডুলি, ঘরের বেড়া। এছাড়াও টুকরি, ঝাকা, কূলা চালনি, খালই, তালাই, প্রভৃতি।
আজো গ্রাম বাংলায় কৃষিকাজ করার জন্য কৃষকের মাথায় মাথাইল ব্যবহৃত হয়ে আসছে। টাঙ্গাইলের বিপুল সংখ্যক নারীপুরুষ বাঁশজাত সামগ্রী তৈরির কাজে নিয়োজিত আছেন। টাঙ্গাইলের পাট বেতের সাহায্যে চমৎকার হস্তশিল্প শীতল পাটি তৈরি হয়। বুনন কৌশলে ও কাজের দক্ষতায় যে কোন সাধারণ পাটিতেও ফুটিয়ে তোলা হয় জ্যামিতিক নকশা। এছাড়া জীবজন্তু, ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, ফুল, লতাপাতা, মিনার, মসজিদ, নৌকা, পালকী প্রভৃতি ফুটে উঠে শীতল পাটির বুননের মাধ্যমে। টাঙ্গাইলের কালিহাতী, ঘাটাইল, বাসাইল, মির্জাপুর, নাগরপুর ও দেলদুয়ারের পাইতারা সম্প্রদায় পটিয়াল বলে পরিচিত। তারা সাধারণ ও শীতল পাটি বুনে থাকে। টাঙ্গাইলের গ্রামাঞ্চলে ৫/৭ ফুট উঁচু একপ্রকার গাছের ছাল দিলে পাটি তৈরি করা হয়। গরমের সময় কারুকার্যময় শীতল পাটি বিছানায় ব্যবহার করলে শরীর ঠান্ডা হয়। এক সময় টাঙ্গাইলের পাটি সুদূর কলকাতাসহ বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি হতো। টাঙ্গাইলে এখনও পাটি বোনার যথেষ্ট কারিগর রয়েছে। বিশেষভাবে এলাসিনের কিছু কারিগরেরা সিলেটের মতো উৎকৃষ্ট পাটি প্রস্ত্তত করতে পারে। কুটিরশিল্পের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় অঙ্গ। কাগমারী, তারটিয়া, মটরা, এলাসিন, কালিহাতী, মির্জাপুর প্রভৃতি পাটুনিদের তৈরি জিনিষসমূহ বিশেষভাবে সমাদৃত। এই শিল্পের সম্ভাবনা এখনো প্রচুর। তবে কাঁচামালের অভাব এবং উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ার ফলে এই শিল্প হুমকির সম্মুখীন।
কাঠ শিল্পঃ
প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই সূত্রধর বা ছুতার আমাদের গ্রাম জীবনের প্রয়োজনে কাজ করে যাচ্ছে। কৃষি সরঞ্জাম যেমন, লাঙ্গল, ঈষ, মই, আচড়া, ইচামুগর, গরুর গাড়ি, গৃহনির্মাণ ও নৌ-নির্মাণে সূত্রধররা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। সামাজিক দাবি মিটানোই টাঙ্গাইলের সূত্রধরদের কাজ। খাট, পালঙ্ক, বারকোশ, পিঁড়ি, টুল, জলচৌকি থেকে শুরু করে আধুনিক টেবিল চেয়ার শোকেস, আলমিরা প্রভৃতি তৈরিতেও টাঙ্গাইলের সূত্রধররা দক্ষতার সাথে কাজ করছে। টাঙ্গাইলের মধুপুর, ধনবাড়ী, কালিহাতী, ঘাটাইল, মির্জাপুর, করটিয়া উল্লেখযোগ্য কাঠশিল্পের স্থান।
জেলায় নদী ও খালের তীরে অনেক এলাকায় নৌকা তৈরি করা হয়। সাধারণ ধরণের নৌকায় করে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে দ্রব্যাদির ব্যবসা বাণিজ্য চলে। তাছাড়া বিভিন্ন ধরণের মাছ ধরার নৌকাও তৈরি হয়।
পোড়াবাড়ির চমচম শিল্পঃ
মিষ্টি দধি ও অন্যান্য দুগ্ধজাত দ্রব্যের জন্য টাঙ্গাইল জেলা প্রসিদ্ধ। পোড়াবাড়ির চমচম এবং বাখিলের দধি টাঙ্গাইলে মিষ্টান্নশিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে। ঘোষ ও পাল সম্প্রদায় এ শিল্পে বংশানুক্রমিকভাবে নিয়োজিত রয়েছে। টাঙ্গাইলের ঘি, মাখন ইত্যাদি দ্রব্যেরও সুপ্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে। টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের ঐতিহ্য আজকের নয়-প্রায় দেড়শ বছরের। এক সময় অনেকে বলেছেন, মৌমাছির মধুবর্ণ চাকের ন্যায় মিষ্টির রসে টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম ভরপুর ছিল। বর্তমানে এর স্বাদ ও মান পূর্বের চাইতে একটু হ্রাস পেয়েছে। তবে বর্তমানে পোড়াবাড়ি চমচম দেশজোড়া খ্যাতি পেয়েছে। বর্তমানে পোড়াবাড়ি থেকে টাঙ্গাইল শহরকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে এই ব্যবসা।
টাঙ্গাইলের কালিহাতীর নরদই, নিশ্চিনপুর, ভূঞাপুর, পোড়াবাড়ি, বাঘিল, নাগরপুর, জামুর্কী, পাকুল্লা ও টাঙ্গাইল শহর মিষ্টি তৈরিতে উল্লেখ্য।
কাগজ শিল্পঃ
টাঙ্গাইলের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রায় শতবর্ষ পূর্বে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন জায়গায় কুটিরশিল্প হিসেবে কাগজ উৎপাদিত হতো। যন্ত্র সভ্যতার আবির্ভাবের সাথে সাথে হাতে তৈরি কাগজশিল্পের বিলুপ্তি ঘটে। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে টাঙ্গাইলের আটিয়ায় পাট থেকে কাগজ তৈরি করা হতো বলে জানা যায়। মেশিনের কাগজের নিকট কুটিরশিল্পজাত কাগজ মার খেয়ে বিদায় নেয়।
বিড়ি শিল্পঃ
টাঙ্গাইলের বিড়ি শিল্প সবার নিকট পরিচিত। বর্তমানে টাঙ্গাইলে এই শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে। অনেক বিড়ি তৈরির ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে। এখানে নারী-পুরুষ একসাথে কাজ করছে।
ঘানি শিল্পঃ
তেলি বা কলু সম্প্রদায় তিল, তিসি, সরিষা প্রভৃতি তৈলবীজ ভেঙ্গে প্রস্ত্তত করে তৈল। ঘানি ঘোরাবার জন্য চোখ বাঁধা বলদ ব্যবহার করা হয়। কলের ঘানির সাথে বলদের ঘানি পাল্লা দিয়ে পারছে না বলে কলুরা আজ পেশাচ্যুত হয়ে পড়েছে। টাঙ্গাইলের এই শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। তাছাড়া টাঙ্গাইলের মুচি ও ঋষিরা মৃত গরুর চামড়া সংগ্রহ করে বিক্রি করে। এদের মধ্যে অনেকে জুতাও তৈরি করে আসছে। এদের অনেকেই ঢাক, ঢোল, তবল, ডুগি প্রভৃতি তৈরি করে থাকে। টাঙ্গাইলের এই মুচিদের সংগঠিত করতে পারলে চর্মশিল্পের অনেক উন্নতি বিধান করা সম্ভব। এছাড়া টাঙ্গাইলের গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরে এক সময় ঢেঁকির প্রচলন ছিল। টাঙ্গাইলের এসব কুটির শিল্পের বিকাশ বহু বছর পূর্ব থেকেই। বিভিন্ন স্থান থেকে বহু লোক এখানে এসে বসবাস করে বংশানুক্রমিকভাবে এসব শিল্পের কাজ শুরু করেছে। টাঙ্গাইলের কুটিরশিল্প ছিল ঐতিহ্যবাহী এবং ঐশ্বর্যমন্ডিত। এই শিল্পের এখনো প্রচুর সম্ভাবনী রয়েছে- শুধুমাত্র উদ্যোগের অভাব। বিপুল সংখ্যক মানুষ উল্লেখিত টাঙ্গাইলের কুটির শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছেন। প্রয়োজন, দক্ষতা বৃদ্ধি, দরকার কাচামাল, ঋণ এবং বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা। নইলে টাঙ্গাইলের এসব শিল্প একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। টাঙ্গাইলবাসীর উন্নয়নে তথা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে টাঙ্গাইলের তাঁত, পাটি, বাঁশ, হস্তজাতদ্রব্য তৈরি প্রভৃতি শিল্পযাতে নতুন উদ্যমে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সে বিষয়ে প্রতিটি সচেতন মানুষ ও সরকারের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
টাঙ্গাইলের বৃহৎ ও ক্ষুদ্র শিল্পঃ
সেই প্রাচীনকাল থেকে অদ্যাবধি টাঙ্গাইলে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনে কর্তৃপক্ষের অনীহা এ জেলার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে রেখেছে। টাঙ্গাইল জেলা শিল্পায়নে প্রয়োজনীয় সম্ভাবনা ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একদিকে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং অন্যদিকে উদ্যোক্তার অভাবে পিছিয়ে রয়েছে। টাঙ্গাইলে প্রচুর পাট জন্মে। গোপালপুরের বিভিন্ন এলাকায় সর্বোৎকৃষ্ট পাট উৎপাদিত হয়। এছাড়া জেলার বিভিন্ন থানাগুলোতেও ভালো পাট জন্মে। কিন্তু টাঙ্গাইলে কোন চটকল নেই। টাঙ্গাইলের সুদীর্ঘ রূপালি আঁশ দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সহায়ক হলেও একদিকে যেমন টাঙ্গাইল পাটকল থেকে পিছিয়ে রয়েছে অন্যদিকে কৃষকের পাট বিক্রিতে তেমন কোন ক্রয় কেন্দ্রও গড়ে উঠেনি। ফলে কৃষক তার উৎপাদিত পাটের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত।
টাঙ্গাইলে প্রচুর উন্নতমানের আখ উৎপাদিত হলেও এখানে একটি চিনিকল প্রতিষ্ঠিত হয়নি। চিনিকল প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ নেয়া হলেও তা কার্যকরী হয়নি। জেলার সদর, ভূঞাপুর, দেরদুয়ার, নাগরপুর ও কালিহাতীতে ইদানীং প্রচুর ইক্ষু উৎপন্ন হচ্ছে।
কাপড় উৎপাদনে টাঙ্গাইল বিশেষ অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেও আজো কোন বৃহৎ কাপড়ের মিল প্রতিষ্ঠিত হয়নি। টাঙ্গাইলের বিপুল সংখ্যক তন্তুবায়ী বন্ত্র বয়নে সুতা, রং প্রভৃতি আনতে হয় বাইরে থেকে উচ্চমূল্যে। মোট কথা টাঙ্গাইলে বৃহৎ শিল্প স্থাপনে সরকারি ও বে-সরকারি পর্যায়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। ফলে টাঙ্গাইলে বেকারত্বের সংখ্যা তুলনামূলক দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।
টাঙ্গাইল জেলার সীমান্তে বে-সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় টাঙ্গাইল কটন মিলস্ ও ইসলাম জুট মিলস্। টাঙ্গাইল কটন মিলস্ পাকিস্তান আমলে এবং ইসলাম জুট মিলস্ দেশ স্বাধীন হবার পর প্রতিষ্ঠিত হয়। টাঙ্গাইলে বৃহত্তর শিল্প বলতে বর্তমানে এ-দুটি প্রতিষ্ঠানকেই বলা যেতে পারে।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS